আগে , মানে ছোটোবেলায় ঋতুগুলো বেশ খবর
দিয়ে –চিঠিপত্র দিয়ে আসতো । এখন যেন এটা
ওটার ঘাড়ে পড়ে কেমন গুলিয়ে যায় । গ্রীষ্মটা কান ধরে বুঝিয়ে ছাড়ে , বাদবাকি মাঝের
ঋতুগুলো কেমন উবে গেছে যেন ! টিভিতে ময়শ্চারাইজার , কোল্ড ক্রিম বা এন্টি
ড্যানড্রাফ শ্যাম্পুর বিজ্ঞাপনের ঘন ঘন
আসা আর কোল্ড ড্রিংকের বিরল হতে থাকা বিজ্ঞাপন ,কখনও বা বদলে যেতে থাকা
ক্যালেন্ডারের পাতা মনে করিয়ে দেয় শীত আসছে ।
জন্ম – বড় হওয়া
সবকিছুই দুর্গাপুরে হওয়ায় ছোটবেলার শীত বেশ জমকালো ছিলো । যেমন ছিলো হাড়ে কাঁপুনি
ধরিয়ে দেওয়া হাওয়া, তেমনই ছিলো তাপাঙ্কের নিরন্তর নেমে চলা -৫- ৪.৫ ডিগ্রি ,প্রায়
প্রতি শীতকালেই নামতো ! তার সঙ্গে ছিলো হাওয়া , যে হাওয়া গ্রীষ্মে লু-য়ে পরিনত হতো
–কারন দুর্গাপুর শিল্প শহর ভৌগলিকভাবে লালমাটির মালভুমি ও
অসমান টিলা , পাথুরে লাল মাটি , শাল সহ আরো
বহুগাছের বাহারে অপরূপ। এমন সাজানো ,পরিকল্পিত শহর এ বাংলায় আর দুটি নেই –এ নিয়ে আজও আমার অহংকারের শেষ নেই । এমনিতেই সবারই নিজের
ছোটবেলার জায়গা বা জন্মস্থানের প্রতি একটা দুবর্লতা থাকেই , তার ওপর সে শহর যদি
দুর্গাপুরের মতো হয় তাহলে তো কথাই নেই !
ঐ শীতের সকালে টিনের বাক্স হাতে দোলাতে দোলাতে
রোজ মর্নিং স্কুল করতে যেতাম, কিছুটা দূরে ছিলো প্রাইমারি স্কুল । সবই ডি
এস পির নিজস্ব , তিনটি মিডিয়াম । বাড়ি থেকে শোয়েটার গ্লাভস পরে বেড়িয়ে এক এক করে
ডাকতাম সব বন্ধুদের স্কুলের পথে যাদের কোয়ার্টার । নাঃ মায়ের অসম্ভব চেষ্টার পরেও
কোনোদিন মাঙ্কিটুপি আমি পড়িনি , ছোটো হলেই বা একটা প্রেস্টিজ নেই ! ফেরাও ছিলো ওই একইভাবে । যেতে আসতে যে কত মজা-
কুকর্ম করতাম সে গল্প বলতে গেলে উপন্যাস হয়ে যাবে । কুয়াশা ঠেলে আমরা কয়েকজন রোজ
ঠিক পৌঁছে যেতাম ঠিক সময়ে ইস্কুলে । নাঃ আমাদের কেউ ইস্কুলে ছাড়তে যেতনা , দরকার
ছিলোনা ,কারন মেনরোড পেরিয়ে যেতে হতোনা ।এক সেক্টর ও অন্য সেক্টরের মাঝে একফালি
মাঠ আমরা পেরিয়ে যেতাম নিজেরাই ,তখন ছোট
ছেলেমেয়েদের ইস্কুলে একা একা নিজেরা যাওয়া খুব স্বাভাবিক ঘটনা ছিলো ।
বাবার ছিলো সিফটিং ডিঊটি মর্নিং-বি-নাইট
। ভেবে দেখুন ওই শীতে ভোর সাড়ে চারটের সময় বাবা বেরতেন যাবতীয় শীতের পোষাক পরে
সার্ভিস হেলমেট নিয়ে , আমি শুধু ঘুমের ঘোরে বাবার কোম্পানীর দেওয়া বদখদ ভারী
সেফটিবুটের আওয়াজ শুনতাম...বাবার জন্য কি মায়া হতো খুব ! কি জানি আজ এত বছর পর মনে
করতে পারছিনা । ছোটবেলার ঝলমলে শরৎ পেরিয়ে যেতেই পাড়ার আশে পাশের গাছগুলোর পাতাঝরা
শুরু হয়ে যেত । মা বের করে ফেলতেন ট্রাঙ্ক,আলমারি থেকে যাবতীয় শীতের পোশাক ,
ফোল্ডিং খাট পেতে রোদে দিতেন । আর আমাদের যত হুটোপুটির জায়গা হতো সেটি , সঙ্গে
ছিলো মায়ের বকুনি ।
মায়ের ছিলো বসন্তমালতী , আমাদের
বোরলীন । সেই শেষ দেখেছি বসন্তমালতী ,
আজকাল যা এনে দি তাই মাখে মা । কোয়ার্টারের বাউন্ডারি ছিলো বড় , আসনে বাগান ,
পিছনে পাঁচিল ঘেরা উঠোন , উঠোনে ছিলো কাঁঠাল গাছ , লেবু গাছ , কলা গাছ – কি অবাক হচ্ছেন ? ছিলো কারন জায়গা ছিলো অনেক এসবের ।
দুর্গাপুরের প্রায় সব কোয়ার্টারেই আপনি পাবেন কম বেশী ফুলের বাগান । আমার বাবাও
বাগান করতেন এবং বেশ নাম ডাকও ছিলো । কোয়ার্টারে সামনে ছিলো বাগান । শীতের মরশুমি
নানা চারা আনতেন বাবা – ডালিয়া,
এস্টার , ক্যালেন্ডুলা, জারভেরা , এন্টিনিনাম , পিটুনিয়া – কত্ত । বেড তৈরি করতে খাটতে হতো খুব , কারন ওখানকার
মাটি কাঁকুরে । চেলে চেলে মাটি তৈরী করতে হতো । আমার বাগানের পাঠ বাবার কাছেই ,
প্রথম দিকে কাজ ছিলো শীত পড়লেই ডালিয়ার চারা লাগাতেন বাবা , ডালিয়া বা অন্য
চারাদেরও প্রথম প্রথম ঢেকে রাখতে হয় । বাবা ছোট ছোট খবরের কাগজের চোং বানিয়ে ঢাকা
দিতেন । আমার কাজ ছিলো সকালে রোদ চড়লেই ঢাকা দেওয়া , বিকেলে তুলে নেওয়া যাতে রাতের
শিশির পায় চারা গুলো ।
উঠোনে ছিলো একটা চৌবাচ্চা । দুপুরে
স্নান করার আগে বেশ করে তেল মাখতাম তখন , মেখে টেখে রোদে বসে থাকতাম কিছুক্ষন-
কারনে এর পর একটা সাংঘাতিক কাণ্ড করতাম তাই তার প্রস্তুতি নিতাম । ওই চৌবাচ্চার
বাসি জলে ভাবতে পারেন হাপুস হুপুস করে স্নান করতাম ! তখন ওটা বেশ বীরত্বের মনে
হলেও এখনও ভাবলে আমার শীত করে । স্নান করেই কাঁপতে কাঁপতে ছুট্টে বাইরের বারান্দায়
রোদে পিঠ দিয়ে বসে থাকতাম । দুপুরে খাওয়ার পরেও কাঁপুনি , আবার বারান্দার রোদ্দুর
...
এক একটা স্ট্রীটে ছিলো ১২+১২ =২৪টা
করে কোয়ার্টার , আমরা থাকতাম প্রথম বারোয় । শীতের দিন গুলোয় মাঠে চলতো সকাল –দুপুর ক্রীকেট ম্যাচ , রাতে নেট টাঙিয়ে বড় জুতোর বাক্সে
লাইট লাগিয়ে ব্যাডমিন্টন । মাঝে মাঝেই হতো পিকনিক , বাড়ি বাড়ি চাল –ডাল –আলু সংগ্রহ করে
অনেকটা বন্যাত্রানের মতো আমাদের পাড়ার ছেলে-মেয়েরা মিলে মেতে ঊঠতাম চড়ুইভাতিতে ,
মাঝ পথে রান্না কেঁচিয়ে ফেলার উপক্রম হলে বড় দিদিরা বা কোনো কাকিমা এসে উদ্ধার
করতেন – সে আনন্দর তুলনা নেই ।
হ্যাঁ পড়াশুনাও করতাম বৈকি , সারাদিন
নানান কান্ড করে , খেলে ধুলে যখন পড়তে বসতাম ঘুমে জড়িয়ে আসতো চোখ । ডিসেম্বরের ২৪ তারিখটি ছিলো আমাদের খুব কঠিন
দিন , আমাদের সময়ে জানুয়ারি-ডিসেম্বর ছিলো পড়ার বছর , তারপর মার্চ হয় , তখন আমরা
স্কুল পেরিয়ে গেছি । এখন আবার জানুয়ারি থেকেই বছর শুরু ।ঐ২৪ তারিখ ছিলো আমাদের
স্কুলের ক্লাসের ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্টের দিন , আতংকের দিন ।
এরপর বড় হতে হতে শীতের সজ্ঞা কিছু বদল
হতে থাকে । সাইকেল নিয়ে কুলবনে যাওয়া পাড়ার চোউহদ্দি পেরিয়ে , লুকিয়ে সিগারেট
খাওয়া, পোদ্দারের পরোটা –আলুরদম , আর
রাস্তার ধারে গাছতলার ঠেকে সন্ধ্যে পেরিয়ে গেলেও আড্ডামারার মতো নিষিদ্ধ জিনিসগুলি
তখন রপ্ত করতে শুরু করেছি । কিন্তু শীতকাল উপভোগ করার ধরন বদলে গেলেও ,বড্ড প্রিয়
ছিলো মাসগুলো । ঝরে যাওয়া পাতা জড়ো করে ‘বুড়ি পোড়ানো’ হতো ,ততোদিনে পলাশগাছে আগুন লেগে গেছে । সেই শীতের
শিশির ভেজা সকালগুলো আজও মধুরস্মৃতির বেদনা হয়ে নাড়িয়ে দিয়ে যায় যখন এই ভিন্ন শহরে
কৃপন শীতের দিনে ভুট্টার গাড়ি এসে দাঁড়ায় বাড়ির সামনে , ভুট্টার খই ভাজার আর্শ্চয গন্ধ
জানালা দিয়ে ঘরের ভিতর ঢুকে পরে। জানিনা এখন আমার প্রিয় শহরের অল্পবয়সি ছেলেমেয়েরা
ঠিক সেইরকম করে চড়ুইভাতি করে কিনা...
Comments
Post a Comment