মাথার ওপর সিলিংফ্যানটাকে
কেউ যেন টেনে ধরেছে , ঘুরছেই না যেন ! কেমন মিন মিন করে পাক খাচ্ছে ! কিছুক্ষন পর
ঠিক যা আন্দাজ করেছিলাম তাই – ‘ক্যাঁও ক্যাঁও’ করে বিচিত্র আওয়াজ করে এবার একদম স্থির হয়ে গেলো পাখা !
সব্বোনাশ ! এদিকে গরমে বস্ত্র উন্মোচন কত্তে কত্তে অন্তিম বস্ত্রখন্ডটিতে এসে
পড়েছি । এরপর আর যাওয়া যাবে না ,গেলে তা সভ্যতার পরিপন্থী হবে ব্যাপারটা । অগত্যা
আমাদের গ্রীষ্মকালীন জাতীয় ( সধারনতঃ পুং) পোষাক বারমুডা নামক বিচিত্রদর্শন কটিবস্ত্রটি
পরেই ছোটাছুটি – দৌড়া দৌড়ি লাঠি দিয়ে ,ঝুল ঝাড়া দিয়ে পাখাটার ওপর ঝাঁপিয়ে পরলাম –
কৃত্রিম উপায় ঘুরিয়ে দিয়ে অনেক সময় চলতে শুরু করে সেই আশায় । অনেকটা ঠেলে গাড়ি
স্টার্ট করার মতো । কিন্তু নাঃ ,নট নড়ন চড়ন ।
এরকম অভিজ্ঞতা আপনাদের
হয়েছে কিনা জানিনা ,তবে না হয়ে থাকলে আপনার ভাগ্য প্রসন্ন । এই যেমন সুন্দর করে
গন্ধ-সাবান দিয়ে স্নান সেরে গরমে পরার উপযুক্ত হাল্কা রঙএর পোষাক গায়ে চাপিয়েছেন
কি চাপাননি – দুর্যোগের মত পাওয়ার কাট ! ব্যাস , কুল কুল করে বিভিন্ন শারীরিক
সোঁতা বেয়ে ঘামের ধারা নেমে আসতে শুরু করলো , এমন নয় যে এর আগে আপনি ঘামেননি !
সেতো কলঘরেই গায়ের জল মোছার পরেই শুরু হয়ে গেছে , এবার প্লাবন এলো । আপনার ঘাড় ও
বাহুমূলের সুগন্ধী ট্যালকামের দফারফা – আবার সেই প্রাকস্নান অম্ল-বাস ধীরে ধীরে
জেগে উঠছে আপনার শারীরিক পরিমন্ডলে , মেজাজ খিঁচড়ে চৌষট্টি । আপৎকালীন বিদুৎএর
বন্দোবস্ত থাকলে ঠিক আছে , নিজেকে যথার্ত ভাবে ‘এলিট’ মনে হবে ।
আপৎকালীন বিদুৎএর
ব্যাবস্থার ব্যাবস্থা আর কদ্দিন! স্কুলে পড়তাম যখন তখন ছিলো তালপাতার হাত পাখা আর বড় বড় কাঁচের চিমনিওয়ালা কেরোসিন ল্যাম্প ।
সেই ল্যাম্পের আলোয় দুলে দুলে পড়া । কোলোনীর বিদুৎ ব্যাবস্থা এমনিতে ভালোই ছিলো
,কিন্তু ঝড়জল হলে তার টার ছিঁড়ে গেলে আর কি করা যাবে । তাছাড়া ছিলো ওখানকার বিদুৎ
অন্য জায়গায় চালান করে তালিতাপ্পির চাপ । বৃষ্টি হলেই কোথা থেকে যেন পিল পিল করে
ঘরে ঢুকে পরতো বাদলা পোকা ! আমারাও তখন খপ খপ করে ধরতাম আর তাদের চালান করতাম
কেরসিন ল্যাম্পের চিমনির মাথায়, চিমনির ভেতর ফেলেদিয়ে মজা দেখতাম! চিমনিতে যে শুধু
বাদলা পোকা পরতো তা নয় ! গার্ডার , প্লাস্টিকের কুচি, দুচার টুকরো মুড়িও পড়তো ।
চিমনির জ্বলমান আলোকিত কাঁচগায় সৃষ্টি হতো পেন দিয়ে বিচিত্র কারুকার্য ! যা
পরেরদিন পরিষ্কার করতে মায়ের অবস্থা সঙ্গীন হয়ে উঠতো । বাদলা পোকাগুলো চিমনির
ভিতরে পড়েই কয়েক মুহুর্তে ছটফটিয়ে খেল খতম । এভাবে আমাদের গবেষণা চলতে থাকতো ,বাইরে
তখন প্রবল বৃষ্টি শুরু হয়েছে । কি নিষ্ঠুর মজা না ! কিন্তু সেতো আজকে বুঝি ,যখন আর
সত্যি সুকুমার নেই । অনেকটা ফড়িং ধরে ল্যাজে সুতো বেঁধে ছেড়ে দেওয়ার মতোই কিংবা
কুকুরের ল্যাজে কালিফটকা বেঁধে জ্বালিয়ে দেওয়ার মতোই ।
সে সব দিন পেরিয়ে এসছি
যখন প্রতি বিকেলে কালবৈশাখী এসে আমাদের মাঠের খেলা নষ্ট করে মন খারাপ করে দিত ।
লোডশেডিং তখন বোধহয় এত অসহ্য লাগতো না , গ্রীষ্মটাও না... কারন পরীক্ষার টেনশন
থাকলেও লম্বা ছূটি ছিলো , আম কূড়ানো ছিলো , ঝোড়ো হাওয়ায় চরকির মতোই ঘুরতে ঘুরতে
ভাসতে ভাসতে ওই অনেক ওপর থেকে নেমে আস
শালফুল ছিলো ... সে এক মায়াবী দিন ছিলো ।
চৈত্র সেল থেকে আনা
সস্তার গোল গলা সূতির গেঞ্জি বা জ্যালজেলে ফতুয়া পরে রাস্তায় বেরিয়েছি । সাঁ করে
একটা স্কুটি চলে গেলো কান চেপে ! কিন্তু চালাচ্ছে কে বোঝার একদম উপায় নেই ! মাথা
থেকে পা ঢাকা ! হাত পুরো ঢাকা বিচিত্রদর্শন একরকম গ্লভস-এ একদম, মাথায় ওড়নার
ফেট্টি ,চোখে রোদ চশমা – হঠাৎ করে দেখলে মনে হতে পারে কোনো মমি স্কুটি চালাচ্ছে ।
কি সমস্যা ! রৌদ্রও নাকি এখন দূষনযুক্ত ! হকচকিয়ে টাল সমলে দাঁড়ালুম ,আর একটু হলে
ফুটের তরমুজ ওয়ালার কোনো একটা তরমুজের রক্তক্ষরন হতে পারতো আমার আঘাতে কিংবা আমিই
চিৎপটাং ! ‘এই তো তরমুজ খাওয়ার সময়’- ভেবে উৎসাহীত হয়ে কিলো কত জিজ্ঞেস করায় বেশ র্যালায়
উত্তর পেলা্ম ‘দশ’ । বেশ একখান বড় দেখে তরমুজ কিনে গদ গদ হয়ে বাড়ি এসে শুনলাম ওটা
নাকি তরমুজ নয় ‘হাতির মাথা’ ! অতবড় তরমুজ কেনার বেওকুফি নিয়ে কয়েক পাত্তর গঞ্জনা
পান করে মনের দুঃখে ছাদে গিয়ে পায়চারি করতে শুরু করলাম । রোদে পুড়ে কেউ বাড়ি এলে
গ্লুকোজ জল ,নিদেন পক্ষে নুনচিনির জল দিতে হয় মনে করাতে শুনলাম রান্নাঘরের
গলদ্ঘর্ম পরিবেশের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে , এবং সে ক্ষেত্রে নিজেই করে নিতে হয়
তাই এক্ষেত্রেও সেটিই প্রযোজ্য । এভাবে লজিক্যালি পিছু হটে বুঝলাম গরমে তেনাদের
মেজাজ বেশ তিরিক্ষি থাকে সেটা মনে রাখা আমার কর্তব্য । এছাড়া বহুদিনের পেন্ডিং
ইস্যু মহার্ঘ ‘মডিউলার কিচেন’ যেখানে কিচেন চুল্লি থাকবে ,যা হু হু করে সব
ধোঁয়া-গরম টেনে নেবে ( যার থেকেই নাকি মুখে র্যাস হচ্ছে অব্যার্থভাবে) সেই ইস্যু
ঊঠে আসবার সম্ভাবনা তৈরী হতে পারে বুঝে কেটে পড়লাম ।
গরমে এসব নানাবিধ সমস্যার
মধ্যে ঘামাচি , র্যাস ,বদহজম এসব জুড়ে
আছে আমাদের জীবনে । দৈনিক কাগজে গরম পরলেই সেইসব সমস্যার নানা সমাধান চোখে পড়ে ।
জল বেশী খান , অন্তত দুবার স্নান করুন , সান্সক্রীম লাগিয়ে বেরোন ইত্যাদি । টিভিতে
একটা বডিলোশন বলছে পচা গরমেও কিরকম অটুট দাম্পত্যপ্রেম ধরে রাখা সম্ভব !
নির্লিপ্তভাবে এসব দেখে যেতে যেতে মনে হয় গরমের কষ্ট কমানোর কত নানাবিধ উপায় আছড়ে
পড়ছে হাতের কাছে , শুধু কিছু রেস্ত খরচ করলেই হবে ।
গরমের কি সবই খারাপ ! নাঃ
তা নয় কিন্তু ।বিকেল হলেই কেমন ফুরফুরে হাওয়া দেয় এক আধদিন , ঘর্মাক্ত শরীর তখন
জুড়িয়ে আসে ছাদে দাঁড়ালে ,মনে হয় জ্বরকপালে মা জলপটি দিচ্ছেন। কিংবা রাস্তায়
সন্ধ্যার দিকে বেরোলে । এইতো সেদিন বেশ একচোট বৃষ্টি হলো সঙ্গে শীল পড়লো , ছোটো
ছেলে মেয়েরা দেখলাম আজও বেশ উত্তেজিত হয় শীল পড়লে ! খাওয়া দাওয়ায় কিছু অবস্যম্ভাবি
পরিবর্তন ঘটে যায় , রোজ হয় টক ডাল ,নয় টক দই , নয় আমের টক । ব্রেকফাস্টে মাঝে মাঝে
রুটি-পরোটার বদলে ভিজে ভাত –চপ – ছাতুমাখা বা চানাচূর । বিহারিদের অভিযোগ ছাতুর
দাম নাকি বাঙালীরাই বাড়িয়ে দিয়েছে । তুমুল
বৃষ্টি হলে আবহাওয়া ঠান্ডা , দুদিন বেশ র্যাসমুক্ত জীবন । গতবারে নাকি গ্রীষ্মে
ঘন ঘন বৃষ্টি পড়ায় সরকারের অনেক রাজস্ব সংগ্রহের ক্ষতি হয়েছে ! বিয়ার বিক্রি
তুলনায় কম হয়েছে বলে । কিজানি ! ভাল্লুকপ্রিয়রা ভালো বলতে পারবেন ।
রাতে শুয়ে এপাশ ওপাশ করতে
করতে কেটে গেলো অনেকটা সময় । পাড়ার কুকুরকূল এই
সময় বড় অস্থীর হয়ে পরে । তুমুল চিৎকারে কান পাতা দায় । ভাবলাম ওদের কেন
ফ্যান নেই ! ভাবতে লাগলাম গ্রীষ্মকাল কেন
আসে ! আসবেই তো ! না হলে আম পাকবে কি করে ! গ্রীষ্ম আসবে কারন তার পরেই তো
বর্ষাকাল , আর কে না জানে বর্ষাকাল হলো প্রেমের ঋতু! এইসব দার্শনিক চিন্তায় নিজেকে
ভাসিয়ে দিতে কষ্টটা দিব্যি কমে এলো । তাই আপাততো বুকভরা ঘেমে ওটা প্রেম কুলুঙ্গিতে
রেখে পাশ ফিরলাম ...যেদিকটা ঘেমে উঠেছে তার বিপরীত দিকে ।
Comments
Post a Comment